কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিং মল, সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার এতটুকুও কমেনি। নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। মাঝে হাতে ঝুলিয়ে ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ বন্ধ ছিল। কিছুদিন যাবৎ সেই ব্যাগও বাজারে ফেরত এসেছে।
ঈশ্বরদীর মাংস বাজার, মুদিবাজার,সবজীবাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, আদা, রসুন বাজারজাত করা হচ্ছে। এমনকি ভারত থেকে যে চাল আমদানি করা হয়েছে সেটাও পলিথিনের বস্তায়। তবে কিছু চালের দোকানে পাটের বস্তা রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পলিথিনের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হোক, তারা তা চান না। কিন্তু পলিথিনের মতো সহজলভ্য কোনো পণ্য বাজারে নেই। ঈশ্বরদী পৌর মার্কেটে সামনে কথা হয় ব্যাংক কর্মকর্তা সাইদুর রহমানের সঙ্গে। তার হাতে হাতওয়ালা পলিব্যাগে বিভিন্ন রকম সবজী। পলিথিনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তিনি বললেন, দোকানদার দিলে কি করব। চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করার ব্যবস্থা তো দেখি না। এটা বন্ধ হওয়া দরকার কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঠেকাতে পলিথিনের ব্যবহার অবশ্যই বন্ধ করা উচিত এবং তা দ্রুত করা উচিত। এ জন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান। সরকার আন্তরিকভাবে না চাইলে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব না বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। ঈশ্বরদী রেলগেইট এলাকায় এক ফল বিক্রেতা বলেন, কাগজের ঠোঙার চেয়ে পলিথিন ব্যগ সস্তা আর এতে হাতল আছে। তাই পলিথিন ব্যগে ফল বিক্রি করে।
এ ব্যাপারে ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, অবৈধ পলিথিন কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালান হচ্ছে,বাজারে ব্যবহুত পলিথিনও অবৈধ। এটি ব্যবহার না করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারনা চালান হচ্ছে। অবৈধ পলিথিন বন্ধে সরকারী কোন নির্দেশ এলে আমরা যথাযত ব্যবস্থা নেবো।
ঈশ্বরদী পৌর মেয়র ইছাহক আলী মালিথা বলেন, অবৈধ পলিথিন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে, ড্রেন ও নালাই পড়ে পর নিস্কাশনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে, ড্রেন বন্ধ হয়ে পানি উপচে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খাল বিল নদীতে পড়ে নাব্যতা হ্রাসসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে,এটি পচনশীল না হওয়ায় মাটির নিচে গিয়ে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট করছে। অচিরেই এই পলিথিন বন্ধ হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। পরিবেশবিদরা বলছেন, পলিথিন নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণেই পলিথিন থেকে মুক্তি মিলছে না। গত বছরের শুরুতে উচ্চ আদালত পলিথিন এবং একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেন। কিন্তু তাতেও বন্ধ হচ্ছে না পলিথিনের উৎপাদন ও বিপণন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পলিথিন নিয়ে চিন্তিত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, বর্জ্য হিসেবে তা পরিবেশ দূষণ করছে। পলিথিন নিষিদ্ধের পর বিকল্প হিসেবে সে সময় কাগজের ঠোঙার ব্যবহার কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু পলিথিনের চাপে কাগজের ঠোঙাও খুব বেশি দিন টিকতে পারেনি। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ২০ বছর ধরে পলিথিন দূষণ নিয়ে চিন্তিত। দেশের বিভিন্ন শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে শুধু আলোচনাই সার।
সরকার বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তার পুরোবাস্তবায়ন হয়নি। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু জনবল ও তদারকির অভাবে অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। ফলে সরকারের সে উদ্যোগের সুফল আর মেলেনি। এ ছাড়া রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলিতে পলিথিন উৎপাদনের যে সব কারখানা রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর সেগুলোতে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। তবে এসব অভিযান লোক দেখানো বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশ অধিদফতরের একশ্রেণির কর্মকর্তার সাথে যোগসাজসে অর্থাৎ অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এসব পলিথিন কারখানা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নেতারা বলেন, পলিথিন নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। সারা দেশেই পলিথিন তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। সরকার যদি আন্তরিকভাবে পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে এটা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ ছাড়া সম্ভব নয়। অতীতে সরকার রাজধানী থেকে পরিবেশ দূষণকারী থ্রি-হুইলার বেবিট্যাক্সি সরিয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবে চেয়েছে বলে সেটা করতে পরেেেছ। পলিথিন বন্ধেও সরকার যদি আন্তরিকভাবে চায়, তাহলে সেটা সম্ভব হবে।